গরীব নেওয়াজ: বানানের জটিলতার কারণে খোদ ‘বাঙালি’ শব্দই আমরা সাধারণ মানুষেরা ছয়ভাবে লিখে থাকি। যেমন : বাঙালি, বাঙালী, বাঙ্গালি, বাঙ্গালী, বাংগালি, বাংগালী। এর প্রেক্ষিতে এমন মতও এসেছে যে, যদি কেউ শুদ্ধভাবে না লিখতে পারে সেটা তার নিজের ব্যর্থতা। হয়তো তাই! কিন্তু কথা থাকে। কেন চারদিকে এত ভুল বানানের ছড়াছড়ি। প্রকাশিত বই, পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, ব্যানার, সাইনবোর্ড, পোস্টার, টেলিভিশন, দাপ্তরিক কাজে সবকিছুতে কেন এত বানান ভুল। এক পৃষ্ঠা শুদ্ধ বাংলা কেন কেউ লিখতে পারে না। এক পণ্ডিতের মত অনুযায়ী শুদ্ধ লিখলেও অন্য পণ্ডিতের মত অনুযায়ী কেন তা অশুদ্ধ হয়। অন্য কোনো ভাষার মানুষ তো নিজ ভাষা লিখতে আমাদের মতো এত ভুল করে না। তাহলে আমরা কি এক মূর্খ জাতি! নিজের ভাষাও আমরা ঠিকমতো লিখতে পারি না। কিন্তু এই আমরাই যখন ইংরেজি লিখি, তখন তো এত ভুল করি না। বাংলা নিয়ে এতদিন ধরে লেখালেখি করছি, তবু অভিধান না নিয়ে বসলে শুদ্ধভাবে কিছু লিখতে পারি না। প্রশ্ন আসে, কেন আমরা নিজের ভাষা লিখতে এত ভুল করি।
আমাদের পণ্ডিতরা শব্দের জাত অনুসারে আমাদের ভাষার শব্দসমূহকে তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র বিভিন্ন জাতে ভাগ করেছেন। এবং জাত অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। প্রতিটি শব্দের বানানে তার জাত-পাত, কুষ্ঠিনামা বিচার করতে হয়।
বিধান দেওয়া হয়েছে, তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত হতে গৃহীত শব্দের বানানে সংস্কৃত বানানের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এই সংস্কৃত নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়েই আমরা ই ঈ এবং তার কার, উ ঊ এবং তার কার, ঙ ং, জ য, ণ ন, ত ৎ, র ড় ঢ়, শ ষ স এবং বিভিন্ন ফলার ব্যবহার-সহ আরও অনেক জটিলতা ও বিভ্রান্তিতে পড়ি। কারণ আমরা সংস্কৃত নিয়ম ঠিকমতো জানি না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত হতে আগত শব্দ যার সংখ্যা আমাদের ভাষায় প্রচুর (২৫ ভাগ), তা শুদ্ধভাবে লিখতে গেলে আমাকে প্রথমে সংস্কৃত ভাষা শিখতে হবে, সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ-অভিধান জানতে হবে, কোনগুলো সংস্কৃত হতে আগত শব্দ তা জানতে হবে—তারপর বাংলা লিখতে হবে। নইলে শুদ্ধ বাংলা লিখা সম্ভব না।
আরবি-ফারসি শব্দ যার সংখ্যাও আমাদের ভাষায় অনেক, তার মূল বানানে সা, সিন, সোয়াদ, শিন, যে, যাল, যোয়াদ, ইত্যাদি ভিন্ন-ভিন্ন আরবি বর্ণ থাকলে সে অনুযায়ী বাংলা বানান ভিন্ন-ভিন্ন হবে। আরবি শব্দের মূল বানান ও উচ্চারণের ওপর আমাদের অনেক বানান নির্ভরশীল। অর্থাৎ বাংলা লিখতে গেলে আগে আমাকে আরবি-ফারসি শিখতে হবে, আরবি-ফারসি শব্দ কোনগুলো তা মুখস্থ করতে হবে, আরবি বর্ণ চিনতে হবে, তাদের আরবি বানান ও উচ্চারণ জানতে হবে—তারপর বাংলা লিখতে হবে।
একইভাবে ইংরেজি হতে গৃহীত শব্দ লিখতে গেলে, সেসব শব্দের ইংরেজি বানানে st, s, se, c, ce, ch, sh, sion, tion, cean, cial, cian ইত্যাদি থাকলে এবং তার উচ্চারণ চ, ছ, স, শ ইত্যাদি যার মতো হবে সে অনুযায়ী বাংলা বানান লিখতে হবে। অর্থাৎ বাংলা লিখতে গেলে আমাকে আগে ইংরেজি শিখতে হবে, ইংরেজি বর্ণ চিনতে হবে, সেসব শব্দের ইংরেজি বানান ও উচ্চারণ জানতে হবে, কোনগুলো ইংরেজি শব্দ তা জানতে হবে—তারপর বাংলা লিখতে হবে। অন্যান্য বিদেশি শব্দও চিনতে হবে এবং তাদের জন্য দেওয়া বিধান অনুযায়ী বানান লিখতে হবে।
তদ্ভব, দেশি, মিশ্র, সমাসবদ্ধ ইত্যাদি শব্দের জন্যও ভিন্ন-ভিন্ন নিয়ম দেওয়া হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত, আরবি-ফারসি এবং ইংরেজি ভাষা না শিখলে বাংলা লিখা সম্ভব না। আরও বহুবিধ নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয়েছে। একটা বড়ো কথা হচ্ছে, আমাদের ভাষার প্রায় দেড় লক্ষের বেশি শব্দের মধ্যে কোনটা-কোনটা সংস্কৃত, কোনটা-কোনটা আরবি-ফারসি বা ইংরেজি বা তদ্ভব বা দেশি তা জানতে হবে। কিন্তু আমাদের পণ্ডিতরা তো এধরনের ভিন্ন-ভিন্ন কোনো তালিকা দিতে পারেননি। তারা নিজরাই তো এক-এক সময় এক-এক রকম কথা বলেন। যেমন : এতদিন বলেছেন পন্থি, দেশি, বিদেশি এগুলো তৎসম শব্দ। তাই দীর্ঘ-ই কার দিয়ে লিখতে হবে পন্থী, দেশী, বিদেশী। এখন আবার বলছেন, এগুলো তৎসম শব্দ নয়, তাই লিখতে হবে পন্থি, দেশি, বিদেশি।
আসলে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে সংস্কৃত, আট শ’ বছর ধরে আরবি-ফারসি, চার শ’ বছর ধরে পর্তুগিজ এবং আড়াই শ’ বছর ধরে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার পর সেসব শব্দ কোন ভাষা থেকে গৃহীত হয়েছে, তা সাধারণভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব না। প্রত্যেক ভাষাই অন্য ভাষা হতে শব্দ গ্রহণ করে থাকে। যা দীর্ঘদিন ধরে ধ্বনিতাত্ত্বিক-রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এ ভাষায় গৃহীত হয়ে থাকে। এভাবে গৃহীত হওয়ার পর তা আর বিদেশি থাকে না। তা এ ভাষারই শব্দ হয়ে যায়। কাজেই সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ইংরেজি এবং অন্যসব নিয়ম বাদ দিয়ে সবকিছু বাংলা উচ্চারণ অনুসরণ করে বাংলা নিয়মে আনলেই বানান সমস্যার সমাধান হতে পারে। অন্যের নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়েই আমরা এত ভুল করছি। বাংলাকে বাংলার মতো করে চলতে না দিয়েই এত ভুল করছি। অথচ একটু ইচ্ছা করলেই ভাষাকে অনেক সহজ করা যায়, সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করা যায়।
এতসব জটিলতা নিয়ে কোনো ভাষা টিকে থাকতে পারে না। একেতো রয়েছে সাধু ও চলিত ভাষার সমস্যা। বিভিন্ন শব্দের সাধু ও চলিত রূপ জেনে সে অনুযায়ী সাধু বা চলিত লেখা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ফলে সাধু চলিত মিলিয়ে আমরা যা লিখি তাকে বলে গুরুচণ্ডালি ভাষা। ৫০টি বর্ণ যার মধ্যে ই ঈ, উ ঊ, ঙ ং, জ য, ণ ন, ত ৎ, র ড় ঢ়, শ ষ স কোনটা কোথায় বসবে তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তাছাড়া ঋ, ঞ, বিসর্গ(ঃ), চন্দ্রবিন্দু(ঁ) এবং বিভিন্ন ফলার ব্যবহার অনেক জটিল বিষয়।
৫০টি অক্ষর, প্রায় তিন শ’ যুক্তাক্ষর, দশটি কার, ছয়টি ফলা, প্রায় ৫০টি বিভিন্ন চিহ্ন এবং প্রতিটি শব্দের জাত-পাত, কুষ্ঠিনামা বিচার করে তার বানান নির্ধারণের এতসব জটিলতা নিয়ে একটি ভাষার পক্ষে বিশ্বায়নের এই যুগে ২৬ বর্ণের ইংরেজি ভাষার সামনে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। টাইপ করতে গেলে সবকিছু মিলে চার শ’-এর বেশি হরফের প্রয়োজন হয়। কী-বোর্ডে এত জায়গা কোথায়। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রায় পৌনে দুই শ’ বছর আগে বর্ণমালার যে সংস্কার করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতে যে বানানবিধি প্রণয়ন করা হয়েছিল তা আজও বহাল রয়েছে। সময় অনেক বদলে গিয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে টিকে থাকতে হলে এ ভাষাকে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করতে হবে এবং তারজন্য বর্ণমালার অনেক কিছু আশু সংস্কার করতে হবে। কীভাবে সংস্কার করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :