Visits: 1

রাগ মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি বা আবেগ। প্রতিটি মানুষের মাঝেই এটি স্বল্প বা বেশি মাত্রায় বিদ্যমান। অনেকের বহিঃপ্রকাশ কম থাকে। তবে এর মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায় তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। রেগে গেলে অনেকে হাত পা ছুড়াছুড়ি করেন, চিৎকার চেঁচামেচি করেন, হুমকি দেন, গালিগালাজ করেন, ভাঙচুর করেন, কথা বলা বন্ধ করে দেন, মেলামেশাও বন্ধ করে দেন। রাগ মানুষের শারিরীক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। রাগ ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে এমনকি নিজ স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। রাগের মাথায় মানুষ খুনও করে ফেলে।
আমরা প্রায়ই মানুষকে রাগারাগি করতে দেখি। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম. অতিরিক্ত গাড়ির হর্ণ, বাসের কন্ডাকটারের আচরণ, রেস্টুরেন্টে ওয়েটার দেরিতে খাবার দিলে, কাউকে ডাকলে আসতে দেরি করলে ইত্যাদি অনেক কিছুতেই খুব রেগে যাই। রাগারাগি করার পর অনেকে বুঝতে পারে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। মানুষের মাঝে সহনশীলতা কমছে, আগের তুলনায় মানুষের মাঝে রাগের বহিঃপ্রকাশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তায় বের হলে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথাকাটাকাটি দেখতে পাই, ফোনে উচ্চস্বরে ঝগড়া করছে। অর্থাৎ আমাদের ধৈর্য কমছে আর রাগ বাড়ছে। রাগ কোনো অর্থেই ভালো না। সংসার, ব্যক্তিসম্পর্কসহ নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করে।
কারণ ছাড়া মানুষ রেগে যায় না। এই কারণের মধ্যে কিছু কারণ আছে গ্রহণযোগ্য, কিছু কারণ অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক। ব্যর্থতা, অযৌক্তিক প্রত্যাশা, হিংসা-বিদ্বেষ ও অন্যের দোষ অন্বেষনে মতো কিছু অভ্যাস ও ঘটনার পাশাপাশি অবিচার, জুলুম ও দারিদ্রের মতো সামাজিক অসঙ্গতিগুলো মানুষের রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে রাগ প্রকাশের ধরনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কিছু লোক আছে, একজনের ওপর রাগ পুষে রেখে অন্যের ওপর তার প্রকাশ ঘটায়। অনেকে আবার সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ কেউ আছেন, শত অন্যায়ের পরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না। যারা রাগকে কৌশলে সংবরণ করে সেই শক্তিকে ভালো কাজে লাগাতে পারেন, তারাই প্রকৃত সফলকাম।
রাগ হলো বারুদের গুদামের মতো। আগুনের স্ফূলিঙ্গের ছোয়ায় সব কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে এই রাগ। এ কারণে রাগ নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। একবার এক সাহাবি হজরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অল্প কথায় কিছু নসিহত করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, রাগ বর্জন করো। সাহাবি কয়েকবার বললেন, আরও নসিহত করুন। প্রত্যেকবারই রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, রাগ বর্জন করো। -(বোখারি শরীফ)। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে রাগ দমনের কথা বলা হয়েছে।
রাগের সময় মানুষ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা রূঢ় আচরণ করে, অনমনীয় থাকে। হুটহাট কিছু করে ফেলে, নানাবিধ কথা বলে ফেলে যা বিভিন্ন সমস্যা, জটিলতা তৈরি করে। হঠাৎ রাগ উঠে গেলে বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। রাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক বিষয় তৈরি হয়, যা সুন্দর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই রেগে যাওয়া প্রশমনের জন্য তাৎক্ষণিক কিছু কাজ করলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবেন। সেগুলো হলো-
(১) যে স্থানে রেগে যাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে সেখান থেকে সরে যাওয়া। বিশেষ করে যার সাথে রাগ হয়েছে তার নিকট থেকে সরে যাওয়া।

(২) যার কারণে আপনি রেগে গেছেন তার সঙ্গে তাৎক্ষণিক কথা বা তর্ক বন্ধ করুন। কথায় আছে ‘বন্দুকের গুলি’ আর ‘কথা’ একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। কথার পিঠে কথা আসতেই থাকে। তর্ক-বিতর্ক বাড়তেই থাকে। তাই কিছুক্ষণ কথা বন্ধ রাখলেই রাগ পড়ে যাবে। এই বিষয় নিয়ে পড়ে কথা বলা। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলুন, সময় নিন। পরিস্থিতি শান্ত হলে রাগের কারণগুলো তার সামনে তুলে ধরুন। ভালোভাবে বুঝিয়ে বলুন পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তার মাথাও ঠান্ডা হয়ে যাবে আপনার কথাও সে ভালোভাবে বুঝতে পারবে।

(৩) ঠান্ডা পানি খাওয়া, যা শরীরে একরকম প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়, মনকে শান্ত করে। হাতের কাছে বরফ থাকলে হাত দিয়ে ধরা। বরফও মেজাজ শীতল করতে সহায়তা করে।

(৪) রাগ থেকে মনকে সরিয়ে নিশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেয়া। বুকভরে গভীর নিশ্বাস নেয়া, কিছুক্ষণ সেটা বুখে ধরে রাখা, তারপর বাতাস ছেড়ে দেয়া। এটি রাগা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
(৫) মনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতে সংখ্যার উল্টা গণনা উত্তম পদ্ধতি। ২০ থেকে ধীরে ধীরে নিশ্বব্দে ১ পর্যন্ত গণনা করতে থাকুন।
(৬) অতিরিক্ত রাগ হলে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়–ন। নিকটে শোয়ার জায়গা না থাকলে বসে পড়ুন তাতে রাগ কমে যাবে।
(৭) রাগ কমানোর ব্যায়াম করুন। নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে রাগের প্রবণতা কমে, সহ্যক্ষমতা বাড়ায়। রাগের সময় কিছুটা পথ হাঁটতে পারেন যা রাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
(৮) রেগে গেলে অনেকে ধূমপান বা নেশা করে। এগুলো মনকে আরো বিক্ষিপ্ত করে তোলে। এগুলো থেকে দূরে থাকুন।
(৯) যে কোনো সমস্যার সমাধান রয়েছে। তাই ঠা-া মাথায় চিন্তা করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা। কিছু সময় নিন। ভাবুন আপনা রেগে যাওয়াটি যুক্তিসংগত কি না।
(১০) চুপচাপ নিজের ঘরে একাকী বসে থাকুন। চোখ বন্ধ করে অন্য কিছু ভাবুন দেখবেন রাগ অনেকটা কমে গেছে।
(১১) রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য হাসিঠাট্টা বা কৌতুকের সাহায্য নিতে পারেন তাতে মনটা হালকা হয়ে যায়। গান শুনতে পারেন। গান মস্তিষ্ককে শান্ত করে।
(১২) মেডিটেশন উত্তম উপায়, যা রাগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শরীরের জন্যও উপকারী।
(১৩) রাগের সময় যারা যার ধর্মের সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলে রাগ কমে যায়। প্রতিটি ধর্মেই অতিরিক্ত রাগের কুফল সম্পর্কে বলা হয়েছে।

(১৪) রেগে গেলে মানুষের চেহারার পরিবর্তন হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটা দেখুন। কেউই আপনার এই রূপটা দেখতে পছন্দ করছে না। আয়নায় নিজের এই চেহারা আপনি নিজে দেখলেও হেসে উঠবেন।

(১৫) নিজেকে বোঝানো রেগে গেলে নিজেরই ক্ষতি, অন্যের কোনো ক্ষতি হবে না। শারীর, মন ভালো থাকবে, অন্যের সাথে সম্পর্কও ভালো থাকবে।

(১৬) নিজেকে নিয়ে বেশি হিসাব করতে গেলে রাগ আরো বাড়বে, তাই তাৎক্ষণিক ব্যাপারটি মেনে নিলে সমস্যা অনেক কমে যাবে।

(১৭) রাগের মাথায় কোনো কিছু বলার আগে বারবার ভাবুন। কিছু বলে ফেললে আর পরিবর্তন করা যাবে না। পরে অনুতপ্ত করেও লাভ হয় না। নিজের মনেই শান্ত হওয়ার মত কিছু শব্দ বা বাক্য পূর্বেই তৈরি করে রাখুন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে যাতে বলতে পারেন- মাথা ঠা-া কর, রিল্যাক্স, কাম ডাউন, টেক ইট ইজি, শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে। দেখবেন এগুলো বললেই মন শান্ত হয়ে যাবে।

(১৮) ভাবনায় ডুবে যাওয়া। রাগ উঠলে চোখ বন্ধ করুন। ভাবতে থাকুন সমুদ্রপাড়ে বসে আপনি সমুদ্র গর্জন শুনছেন, খোলা আকাশের নিচে বাতাস খাচ্ছেন, বই পড়ছেন। অতিথি পাখির শব্দ উপভোগ করছেন। দলবেঁধে চলা প্রজাপতির পাশে ভাসছেন, জ্যোসনা রাতে ছাদে শুয়ে আছেন ইত্যাদি। এই কল্পনার জগতে প্রবেশ আপনার রাগ প্রশমিত করবে।

(১৯) যার উপর রেগে আছেন তাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার ভেতরের ইতিবাচক দিকগুলোকে জাগরিত করুন।

(২০) রাগের সময় যা মনে আসছে তা লিপিবদ্ধ করতে চেষ্ট করুন। কষ্ট, হাসি, দুঃখ এই অনুভূতিগুলোকে ভাষায় লেখায় বন্দি করে রাখার অভ্যাস তৈরি করুন। দেখবেন কখন আপনার রাগ প্রশমিত হয়ে গেছে আপনি নিজেও টের পাবেন না।

নিজেকে জানতে হবে। নিজের রাগ সম্পর্কে জানতে হবে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবুন রেগে গেলে আপনি কি কি করেন। কেউ যদি তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তবে প্রথমেই তাকে অনুধাবন করতে হয় তার রাগের মাত্রা কতটা ভয়াবহ। মানুষকে তার শরীর সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অসুস্থ হলে রাগ দমন করা কঠিন। তাই পূর্বে থেকেই রাগ কমিয়ে আনার অভ্যাস করতে হবে। অবসর যাপন, সুস্থ বিনোদন রাগ কমাতে সহায়তা করে। রাগ কমাতে আপনার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। রেগে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বুঝতে পারলেই নিজেকে গুটিয়ে নিন। কেউ আপনার রাগকে উত্তেজিত করে তুলছে বুঝতে পারলেই তাকে এড়িয়ে চলুন।
নৈতিক শিক্ষা মানুষকে রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে সাহায্য করে। সূরা আল ইমরানের ১৩৪ আয়াতে বলা হয়েছে-‘‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ-ক্রটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।’’ মহৎ, সৎ ও আধ্যাত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ ব্যক্তিরা সব সময় অন্যের জন্য দোয়া করেন। মানুষকে সংশোধন করে দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদন জানান। তাদের কথা হলো, কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব আপনার ওপর রেগে থাকলে ক্ষুব্ধ লোকটির কাছে গিয়ে নম্রভাবে তাকে সান্তনা দিন, তার ক্ষোভ উপশমের ব্যবস্থা করুন, যাতে সে শান্ত হয়। এমনটি করলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিটির ক্ষোভ কমবে, তার কোনো ক্ষতি করার পরিকল্পনা থাকলে তা থেকে সরে আসবে।
সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জুলুম ও বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অপরাধী ও জুলুমবাজদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাগ বৈধ। তবে অন্যায় দমন করতে যেয়ে অন্যায়কে যাতে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাগ হলে আলেমরা ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আবু দাউদ শরীফের একটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রাগ আসে শয়তানের কাছ থেকে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন নেভাতে লাগে পানি। তাই যখন তোমরা রেগে যাবে, তখন অজু করে নেবে।’ আর মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে রাগের সময় নিজেকে সামলে নিতে পারে, সেই প্রকৃত বাহাদুর।

লেখক – লেখক- কামরান চৌধুরী, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক,অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *