শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তিনিই শিক্ষক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতদেরই শিক্ষক বলা হয়। শিক্ষকের লব্ধজ্ঞান সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার নাম শিক্ষকতা। শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। কেননা একজন আদর্শ শিক্ষক পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান ও ন্যায়ের দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
একজন শিক্ষক সব সময় একজন ছাত্র। একজন ভালো শিক্ষকের নিজের শিখার আগ্রহ থাকতে হবে। কেননা নিজে শেখার আগ্রহ না থাকলে ছাত্র-ছাত্রীদের শিখাবার আগ্রহ তৈরি করতে পারেন না। একজন ভালো শিক্ষককে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মন বুঝতে হবে। ভালোভাবে বোঝানোর কৌশল জানতে হবে। তাঁর ভাষা ও উচ্চারণ মানসম্মত হতে হবে। আচার-আচরণ হবে ভদ্র। সততা ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন তিনি। হবেন ধৈর্যশীল ও বিবেক সম্পন্ন মানবিক গুণের অধিকারী একজন মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব হবে এমন যেন তাঁর আদর্শে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনকে উজ্জীবিত করতে পারে। তিনি এমন একজন কাণ্ডারী হবেন যিনি তাঁর শিক্ষার্থীকে সঠিক পথ দেখানোর হাল ধরবেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যাঁর শিক্ষা ও স্মৃতি দীর্ঘকাল শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে থাকে। একজন শিক্ষক কেবল পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালনা, মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক নিয়মিত দায়িত্ব পালনেই ভ‚মিকা রাখেন না, তিনি তাঁর শ্রেণিকক্ষে একজন নেতা যাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির ছোঁয়া শিক্ষার্থীদের কাছে অনুসরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। একজন শিক্ষককে বর্তমানে প্রচলিত জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা রেখে তার শিক্ষণ শেখানো কার্যক্রম দক্ষতার সাথে পালন করতে হয়। শিক্ষক তখনই একজন সার্থক শিক্ষক যখন তিনি লাইফ লং লার্নার। শিক্ষককে জ্ঞান সম্পর্কে পিপাসা, সৃজনশীল মনোভাব এবং যুগোপযোগী পরিবর্তন করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়।
একজন আদর্শবান শিক্ষককে ভালো শ্রোতা হতে হয়। একজন ভালো শ্রোতা নতুন ধারণা, পদ্ধতি, নীতিমালা গ্রহণে সদা প্রস্তুত থাকেন। একই সাথে নতুন জ্ঞানকে গ্রহণ ও আদান-প্রদান করা, সহকর্মীদের কথা শোনা-তাদের সাথে বিশ্বস্ত সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। একজন শিক্ষকই পারেন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, উপস্থাপনের দক্ষতা, শ্রেণিকক্ষে সহযোগীয় মনোভাব, বিদ্যালয়ে লিডারশিপ ধারণা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট জ্ঞান, পরিবর্তশীল মনোভাব, প্রেষণা প্রদান, পরিকল্পনা প্রণয়ন, সাংগঠনিক দক্ষতা, সমন্বয় সাধনের দক্ষতা ইত্যাদিকে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য বৃদ্ধিতে পরিণত করা।
শিক্ষার্থী অপেক্ষা শিক্ষককে বেশি পড়তে হবে। তিনি প্রতিনিয়ত পড়াশোনার মাঝে থাকবেন এবং তার জানার আগ্রহকে শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দেবেন। শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটি ব্রত। শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন তৈরি করে নিবেন। একজন ভালো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তুর সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেন শিক্ষার্থী চাইলেও আর সেখানে থেকে বের হতে পারে না। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের যেকোনো সমস্যায় শিক্ষকের কাছে আসবে এবং শিক্ষক তাদের তা থেকে উত্তরণের সহজ সমাধান করে দিবেন। এমন অনেক মানুষ আছে যারা যেকোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ে। কিন্তু একজন শিক্ষক নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করে ফেলেন যে কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারেন এবং যে কোনো ধরনের পরিবর্তনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সব সময় সত্যের পথে চালিত করে থাকেন। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের ন্যায়ের পথে সত্যের আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে, সাহস দিয়ে তাদের মনোবল দৃঢ় করার দায়িত্বও শিক্ষকের ওপর থাকে। বিদ্যালয়ের সাথে সাথে একজন শিক্ষক সমাজেরও শিক্ষক। বিদ্যালয়ের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়ন ও শিক্ষক কর্তৃক প্রভাবিত। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন শ্রদ্ধাবোধ থাকা চাই, তেমনি শিক্ষার্থী যত ছোট হোক না কেন তারও সম্মান আছে। তাকেও সেটা দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শাস্তি দেয়াটা অমানবিক, তবে শিক্ষার্থীর স্বাধীনতার একটা সীমানা থাকা জরুরি। শিক্ষক একজন আদর্শ ব্যক্তি, তিনি বিদ্যালয় এবং সমাজের নেতা-এই বোধকে শিক্ষার্থীও মনে ধারণ করানোর দায়িত্ব একজন শিক্ষকের যেমন তেমনি শিক্ষার্থীর পরিবারেরও। তবেই একজন শিক্ষার্থী মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে অগ্রসর হবে।
আমাদের শিক্ষকদের বৃহত্তর অংশ শিক্ষকতার পেশায় আসেন কেবল জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পেশাটির প্রতি ভালোবাসা ও গভীরভাবে পেশাটিকে মহিমান্বিত করার আগ্রহ তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হওয়া চাই। যদি একজন শিক্ষক সত্যিকারের সৃজনশীল হন, মনস্তাত্তি¡¡ক অনুধাবনের চেষ্টা করেন তাহলে সেই শিক্ষককে হৃদয় দিয়ে ধারণ করে শত শত শিক্ষার্থী। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তি বিল গেটস বলেন, একজন মানুষ কখনো ব্যর্থ হবে না-এই বোধ তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত করে দেন একজন সৃজনশীল শিক্ষক।
শিক্ষার লক্ষ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটা হলো আত্মিক। শিক্ষক কতটা আদর্শবান, নৈতিক মনোভাব সম্পন্ন তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীর ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। শিক্ষার্থীর দেহ মন ও আত্মার বিকাশ সাধনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পরম বন্ধু, উপযুক্ত পদপ্রদর্শক এবং বিজ্ঞ-বিচক্ষণ দার্শনিক। তিনি মেধা, মনন, আচরণ, বচন ও বসনে হবেন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। কারণ শিক্ষক শুধু বইভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষক নন, তিনি সমাজ সংলগ্ন ও সামাজিক চেতনায় সমৃদ্ধ একজন ব্যক্তিত্ব। শিক্ষার্থীর সামনে তিনি উপস্থিত করেন চলমান সমাজকে নানারূপ ও নানা মাত্রায়। একজন শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান সমাজ প্রয়োজনের প্রাসঙ্গিক না হলে সে জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো যৌক্তিকতা নেই। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মনস্তত্তে¡র গুরুত্বপূর্ণ পাঠক। শিক্ষাবিদ গিলবার্ট হায়েটের মতে, আদর্শ শিক্ষকের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য শিক্ষার্থীর প্রতি গভীর মমতা, বিষয়ের প্রতি অনুরাগ এবং নিজ পেশার প্রতি অনুরাগ। শিক্ষক যখন শিখাবেন তখন তিনি শিক্ষার্থী হয়ে যাবেন। ক্লাস হবে অংশগ্রহণমূলক, লাইভ, সাউন্ড।
শিক্ষক মানেই গুরুগম্ভীর মানুষ-এই ধারণা এখন পাল্টে গেছে। এখন শিক্ষক হওয়া চাই অন্যরকম, বন্ধুর মতো, তবে বন্ধু নয়। একসময় ছিল গুরুমুখী বিদ্যা। যেখানে গুরু হাতে-কলমে শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। এরপর এলো লেকচার সিস্টেম অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক শুধু আলোচনা করবেন আর শিক্ষার্থীরা শুধু তা গলাধঃকরণ করবে। কিন্তু এখন উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও চালু হয়েছে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভর করে যাতে শিক্ষার্থীরা পার পেতে না পারে, যাতে তারা নিজের ভিতরে সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে পারে এইজন্য চালু হয়েছে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি। একজন আদর্শ শিক্ষক নিজেকে সব সময় প্রস্তুত রাখেন শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তুলে তার সকল কৌতূহল মিটাতে। কাজেই একজন আদর্শ শিক্ষক যে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীকে উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান করবেন। কঠিনকে সহজ করে দেখবেন, বিষয়ের সাথে শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করবেন। দেশকে ভালোবাসবেন। শিক্ষাদানে আনন্দ পাবেন। পড়ানোর মাধ্যমকে আনন্দময় করে তুলবেন। শিক্ষার্থীর আত্মাকে উদ্বোধিত করবেন নিজ আত্মাকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে। জ্ঞানী হলে শিক্ষক হওয়া যায় না এবং শিক্ষকতা একটি ধর্ম- এটিই অন্তরে ধারণ করবেন। -লেখক: আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :