বায়ুদূষণের বর্তমান আগ্রাসন থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে


নিউজ সমাহার প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:৩০ পূর্বাহ্ন /
বায়ুদূষণের বর্তমান আগ্রাসন থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে

আব্দুল হাই রঞ্জু: সুস্থ শরীরে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে অপরিহার্য উপাদানগুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ বায়ু অপরিহার্য হলেও আমাদের দেশে দূষিত বায়ুর আগ্রাসন দিন দিন বেড়েই চলছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বায়ু খুব সহজলভ্য একটি উপাদান, কিন্তু আমাদের দেশে নির্মল বায়ু প্রতিনিয়তই অতিমাত্রায় দূষিত হচ্ছে। ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। অতিসম্প্রতি শিকাগো ইউনিভার্সিটি অব এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশ এখন মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। রাজধানী ঢাকা তো বটেই, এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ চারটি জেলা বায়ু দূষণজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ওই গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। এমনকি ওই গবেষণায় সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, শুধু বায়ু দূষণের কারণে গড়ে একজন বাংলাদেশির আয়ু কমে যাচ্ছে ৬ দশমিক ৮ বছর করে। এয়ার কোয়ালিটি লাইভ ইনডেক্স (একিউএলআই) অনুসারে, শিল্প কলকারখানা অধ্যুষিত গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে বায়ুদূষণকারী কণা রয়েছে ৮৯.৮ বা পিএম ২.৫, যা পুরো দেশের বাতাসের মধ্যে সর্বাধিক। এর পরের অবস্থানে নোয়াখালী। সেখানে ৮৮.৭ পিএম বা ২.৫ কণা রয়েছে বায়ুতে। যা ঢাকার বায়ু কণার চেয়েও বেশি। তাহলে এখানে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বায়ুদুষণের মাত্রা ঢাকা শহর ছেড়ে এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শীতের কুয়াশার মতো ধুলায় আচ্ছাদিত রাস্তা। চলন্ত যানবাহনের পেছনে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাসে উড়ছে ধুলা-বালি। সড়কের ২ পাশে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুলায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। আর এসব ধূলিকণা এত সূক্ষ্ম যে, যা মানুষের শরীরে সহজে ঢুকে নানা রোগের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীরা আরও অসুস্থ হচ্ছে। এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, ক্ষুদ্র ধূলিকণা মানুষের ফুসফুসে সহজে ঢুকে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারেরও জন্ম দিচ্ছে। আর সর্দি, কাশি, ইনফুয়েঞ্জা, অ্যাজমার প্রকোপ তো দিন দিন বেড়েই চলছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

অথচ শৈশবে দেখেছি চৈত্র, বৈশাখ মাসে পানিশূন্য জমিতে ধুলার কি ব্যাপকতা। সে সময় এখনকার মতো সেচভিত্তিক চাষাবাদ ছিল না। শুকনা জমিতে চাষাবাদ করত চাষিরা। তার পরও রোগব্যাধির আধিক্য এত ছিল না। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন যানবাহনের কালো ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, নির্মাণসামগ্রীর ধুলায় বিপর্যস্ত জনজীবন। ফলে রোগবালাই বাড়ছে মানুষের। এখন গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা পাকা করা হয়েছে। আগের মতো ধুলায় আচ্ছাদিত কাঁচা রাস্তার তেমন দেখা মেলে না। তার পরও এখন বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছেই। এর মূলেই রয়েছে পরিবেশ ধ্বংসকারী যানবাহনের এবং কলকারখানার ধোঁয়া। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে মুক্তির কোনো পথ নেই। যেমন এখন নগর, মহানগর, মফস্বল শহর, এমনকি উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত ছোট-বড় উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।

এসব উন্নয়ন কাজের কারণে ধুলার সৃষ্টি হচ্ছে। যা মানুষের দেহে সহসাই প্রবেশ করে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। অথচ নির্মাণ সংস্থা কিংবা সরকারের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বাস্তবতা হলো, দূষণ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করলে ধুলো দূষণের আগ্রাসন অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু নির্ঘাত সত্য হলো, দায়িত্ব পালনে সবার অবেহলার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। যেমন নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণকাজের সময় রাস্তায় কিংবা কর্মস্থলে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করলে এ সংকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে পানি ছিটানোর বিল প্রদান করা হলেও কাজটি সেভাবে করা হয় না। অথচ নির্মাণ সংস্থা শুধু ধুলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ম অনুযায়ী ওই আইটেমের বিল প্রদান বন্ধ রাখলে ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কাগজ-কলমে আইনে থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ আদৌ হয় না। যে কারণে আইনের শাসনকে নিশ্চিত করা একান্তভাবে জরুরি। যেমন বিশ্বের বড় বড় শহরে পাকা রাস্তার বাইরের সব জায়গায় ঘাসের আচ্ছাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেখা যায়, নগর, মহানগর এমনকি মফস্বল শহরে ড্রেনের ময়লা তুলে তা দিনের পর দিন ড্রেনের পাশে স্তূপ করে রাখায় সেসব শুকিয়ে ধুলাবালুর সৃষ্টি করছে। যা সহজেই বাতাসের সঙ্গে উড়ে পথচারীদের নাকে-মুখে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে।

আবার অনেক সময়ই দেখা যায়, শহরের বর্জ্য ও ময়লা উন্মুক্ত গাড়িতে করে অপসারণ করায় সহজেই বায়ুদূষণ ঘটছে। এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা হরহামেশাই চোখে পড়ে। অথচ কর্তৃপক্ষ একটু সচেতন হলে বর্জ্য অপসারণের এসব গাড়িকে ঢেকে নেওয়া কিংবা আচ্ছাদিত বডি ব্যবহার করলে দূষণের পরিমাণ কমে যাবে। স্মরণে রাখা জরুরি যে, আমাদের শহরগুলোয় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বর্জ্যরে পরিমাণও বাড়ছে। ফলে মান্ধাতা আমলের বর্জ্য অপসারণের পথ থেকে সরে এসে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার দিকেই আমাদের এগোতে হবে। আবার বর্জ্য অপসারণ করে তা শহর থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে না ফেলে শহরের কাছে ফেলা হচ্ছে। অথচ এসব বর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তরিত করতে প্রতিটি শহরের পাশে জৈব সার উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করলে বর্জ্য সমস্যা না হয়ে বরং সম্ভাবনার দুয়ারকে উন্মোচিত করত। কারণ আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমিতে জৈব সারের বড়ই অভাব। যে কারণে অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে ফলন বিপর্যয় ঘটছে। অথচ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প নেই। অর্থাৎ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে আমরা যেমন ধুলাদূষণ, বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারি, তেমনি সমৃদ্ধ দেশ গঠনে এসব বর্জ্যকে সম্ভাবনায় পরিণত করাও সম্ভব হবে।

শুধু উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, পরিকল্পিতভাবে আমাদের এগোতে হবে। বর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তরের জন্য বর্জ্য থেকে সার উৎপাদনের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যাপকভাবে কারখানা স্থাপন করতে হবে। তা হলে দেখা যাবে, একদিকে দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে মাটির গুণাগুণ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈব সার দেশীয়ভাবে জোগান দেওয়াও সম্ভব হবে। আবার বর্জ্য আগ্রাসনের পাশাপাশি কয়লা ব্যবহারের পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে। যে মুহূর্তে শিল্পোন্নত দেশগুলো কয়লাভিত্তিক প্রকল্প পরিত্যাগ করে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে, সে মুহূর্তে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পথেই হাঁটছি। যা পরিবেশ রক্ষার জন্য বড় অন্তরায়। কয়লাভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে কারণে পরিবেশ আরও উষ্ণ হচ্ছে। জানা গেছে, কয়লাভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা প্রায় ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা পক্ষান্তরে পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে দেরিতে হলেও সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেমন বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের যে সুযোগ রয়েছে, তা আমাদের কাজে লাগানো উচিত। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পোড়ানোর কারণে প্রতিদিন আর্সেনিক, পারদ, সিসা, নিকেল, ভেনানিয়াম, বেরোলিয়াম, বেরিয়াস, ক্যাডসিয়াম, ক্রসিয়াম, মিলেনিয়াম, রেডিয়ামসহ আরও প্রচুর পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থসমৃদ্ধ ফাই অ্যাশ ও বটম অ্যাশ উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ এসব মানবস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।

ধুলাদূষণ, বায়ুদূষণের বর্তমান আগ্রাসন থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই অপরিহার্য। এজন্য সরকারকে বায়ুদূষণ রোধে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, উৎপাদন ব্যবস্থাকে পরিবেশবান্ধব রাখতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে সম্মিলিতভাবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত অর্থে বাস উপযোগী নির্মল পরিবেশকে নির্বিঘ্ন রাখা আদৌ সম্ভব হবে না।

লেখক: কলাম লেখক